বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023

বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব আলোচনা কর

উঃ) চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী ঘটনা। তার ভক্তি প্রেম, তথা মানবপ্রেম, ধর্ম প্রচার এবং চিন্তাভাবনার প্রভাবে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যে বিপুল পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তন হয়ে ওঠে এক উন্নত সৃষ্টির প্রেরণা। চৈতন্যদেব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “বর্ষা ঋতুর মতো মানুষের সমাজে এমন একটা সময় আসে যখন হওয়ার মধ্যে ভাবের বাষ্প প্রচুর পরিমাণে বিচরণ করিতে থাকে। চৈতন্যের পরের বাংলাদেশের সেই অবস্থা আসিয়াছিল” বস্তুতঃ মধ্যযুগের ষোড়শ শতাব্দীকে বাংলা সাহিত্যের সুবর্ণ যুগ বলা হয় এবং সেই সুবর্ণ যুগের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তমসাচ্ছন্ন বাঙালি জাতিকে, তিনি নবজাগরণের মন্ত্রের দীক্ষিত করে, বাঙালি জাতিকে নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখালেন। তাই তিনি মানবতার এক আদর্শস্বরূপ যুগপুরুষ হয়ে উঠেছেন

বাংলা সমাজে চৈতন্য প্রভাব:-  (বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023)  

১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় নবদ্বীপে চৈতন্যদেব আবির্ভূত হন।  একদিকে তুর্কি বিজয়ের অভিঘাতে বাঙালি জাতি দিশেহারা এবং পর্যুদস্ত, অন্যদিকে ধর্মান্তরিতকরণের প্রবল স্রোতে বাঙালি হিন্দু সমাজ বিপন্ন। এই তমসাচ্ছন্ন যুগে, চৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়ে বাঙালি জাতিকে নবজাগরণের মন্ত্রে দীক্ষিত করে, নতুন জীবন স্রোতে চালিত করলেন। নবদ্বীপ হয়ে উঠল নবজাগৃতির পিঠস্থান।

ধর্ম, গোষ্ঠী, জাতিবিভেদ, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি থেকে মুক্ত করতে এবং স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে এক ছাতার তলায় দাঁড় করিয়ে বাঙালিকে, প্রেমের ধর্মে মন জয় করে নিলেন তিনি। বৃহত্তর মানব সমাজকে চৈতন্যদেব শোনালেন- “চন্ডাল চন্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ বোলে” মানব প্রেম ও নাম সংকীর্তন ছিল  চৈতন্যের সমস্ত রকম বিরুদ্ধ শক্তির মোকাবিলার প্রধান অস্ত্র। ইসলামী শাসনে বাংলাদেশ ও বাঙালির সমাজ জীবনে যখন অস্থিরতা পরাজয়, মানুষের মনুষ্যত্ব যেখানে ভুলুন্ঠিত তখন আসমুদ্রহিমাচল মানবজাতিকে আলিঙ্গন করে, কৃষ্ণ নামে মাতোয়ারা করে জাতিকে বাঁচার স্বপ্ন দেখালেন।

চৈতন্য দেব ছিলেন মানবতার মুর্ত প্রতীক। যুগের প্রয়োজনেই মানুষ তাকে অবতার রূপে চিহ্নিত করল। অদ্বৈত, শ্রীবাস, মুরারি, চন্দ্রশেখর প্রভৃতি সকলেই মিলিত হলেন নবদ্বীপে। সকলে তার অবতার রূপকে মেনে নিলেন। সমাজে এমন এক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ চাইছিলেন যিনি এই অন্ধকার জীবন থেকে উদ্ধার করে তুলবেন। চৈতন্যদেব মানুষকে বুকে টেনে নিয়ে তাদের বাঞ্ছিত পথকে সুগম করলেন।  (বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 )

সমস্ত সংকীর্ণতার ওপরে উঠে যেভাবে শ্রীচৈতন্য অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে মানুষে মানুষে সমভাবের কথা বলেছিলেন, সেকালের পক্ষে তা ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক।শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে জনরুচির সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটেছিল। স্থূল গ্রাম্যতার পরিবর্তে পরিচ্ছন্ন মার্জিত রুচিবোধের জাগরণ ঘটেছিল জনমানসে।সেই সময়কার নীতিভ্রষ্ট সমাজে তার প্রভাব নৈতিক মানোন্নয়নের সহায়ক হয়েছিল।ভিন্ন ধর্ম বা ধর্মসম্প্রদায় সম্পর্কে সহিষ্ণুতা গ্রহণের শিক্ষা দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি শিখিয়েছিলেন তরু বা গাছের মতো বিনয়ী হতে।

হিংসা-দ্বেষ-কলুষতাপূর্ণ বাঙালি সমাজে সর্বশক্তিমান প্রেমকে প্রতিষ্ঠিত করে শ্রীচৈতন্যদেব বাঙালিকে বাঁচতে শিখিয়েছেন। অসাম্য, বিভেদ, অনাচার, মোহ ও কুসংস্কারের বিপরীতে সামাজিক সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করে তিনি এক বিশাল সমাজ-বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, ধর্মকে কেন্দ্র করে তিনি সেকালের বাঙালি জীবনে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন, যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।

চৈতন্যদেব যুগসত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন যে সমাজের বৃহত্তর অংশে যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল, তাকে রোধ করতে হলে এমন এক মতবাদ প্রচার করতে হবে, যা সর্বজনের পক্ষে গ্রহণযোগ্য আচরণীয় হয়ে উঠতে পারে। অতএব নিছক হৃদয়বৃত্তি থেকে উদ্ভূত প্রেমধর্মের প্রচারই চৈতন্যজীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠলো। ভক্তিবাদের ভিত্তিতে গঠিত এই প্রেমধর্মে সর্ব জীব আশ্রয় লাভ করতে পারে। সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় মতবাদের গোঁড়ামি, মানুষে মানুষে ভেদজ্ঞান-আদি প্রেমধর্মে স্পষ্টতঃ অস্বীকৃত হলো।

ব্রাহ্মণদের শূন্যগর্ভ অহংকারকে তিনি ধিক্কার জানিয়ে বিনয় ও সহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করলেন। এর ফলে বৃহৎ জনসমাজ থেকে দর্পের কারণে বিচ্ছিন্ন ব্রাহ্মাণদের সামাজিক গ্রহণশীলতা অনেক বৃদ্ধি পেল। এরপর চৈতন্যদেব স্বয়ং যখন ‘আচণ্ডালে ধরে দেয় কোল’, তখন সমাজের সর্বনাশা ভাঙ্গনের পথ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এলো। যখন চৈতন্যদেবের মতে- ‘চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তিপরায়ণঃ’, তখন চিরকালের নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষ মুক্তির আহ্বান শুনতে পেলো। বস্তুতঃ এর আগে আর বাঙলাদেশে এমনভাবে মানবমুক্তির উদার আহ্বান কখনও ধ্বনিত হয়নি।

এই আহ্বান অনতিবিলম্বেই সাড়া জাগালো সমস্ত ভারতে, সমস্ত জাতির মধ্যে শুধু চণ্ডালই নয়, যবনও পেল প্রেমধর্মে আপনার অধিকার। ফলে সমগ্র দেশেই দেখা দিল এক অপূর্ব ভাববিপ্লব, যার সহায়ক হলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু। এই ভাববিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফল সমাজজীবনে অনুভূত হলো নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে ও ব্যাপক হারে নিম্নবর্ণের হিন্দুর মুসলিম ধর্ম গ্রহণ বন্ধ হলো, নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও বহু ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের সঙ্গে সমান অধিকার লাভ করায় হিন্দুধর্মের সঙ্কীর্ণতা অনেকাংশে দূরীভূত হলো; সন্কীর্তনে উচ্চনীচ কোন ভেদাভেদ ছিল না; নিম্নবর্ণের হিন্দু বা মুসলমানও বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করলে সমান অধিকার ভাগে করতো; গুরুগিরিতে ব্রাহ্মণের যে একচেটিয়া অধিকার ছিল, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে তা’ অপরদের মধ্যেও সম্প্রসারিত হলো। স্বাভাবিকভাবেই ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীকে চৈতন্য যুগ বলাই বাহুল্য  (বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023)

সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব :-   বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023

তখন সমস্ত আকাশ প্রেমের রসে আদ্র হইয়াছিল। তাই দেশে সেই সময় যেখানে যত কবির মন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছিল সকলেই সেই রসের বাস্পকে ঘন করিয়া কত অপূর্ব ভাষা এবং নতুন ছন্দে কত প্রাচুর্যে ও প্রবলতায় দিকে দিকে বর্ষণ করিয়াছিল”- রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত তিনি কয়েকটি পদ ছাড়া বিশেষ কিছু লিখে যাননি। অথচ তাকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের বাংলা

সাহিত্যে জোয়ার আসে। তাকে কেন্দ্র করেই বাংলা সাহিত্যের পরিপূর্ণতা লাভ করে। বলা যায়, মধ্যযুগের বিশেষ করে ষোড়শ শতাব্দী বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। আর যাকে কেন্দ্র করে এই স্বর্ণযুগ সৃষ্টি হয়েছে- তিনি হলেন মানবধর্মের মূর্ত প্রতীক চৈতন্যদেব। তার আবির্ভাবেই সমকালীন বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শাখা- প্রশাখা বিস্তার লাভ করে।

বাংলা সাহিত্যে প্রথম মানবকে নিয়ে সৃষ্টি হল জীবনী সাহিত্য। বস্তুতঃ সাহিত্যে রাজরাজাদের জীবনচরিত কবিদের দ্বারা কীর্তিত হতো। কিন্তু চৈতন্যের প্রেমময় জীবনকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধরার প্রবর্তন হল, যার নাম- জীবনীকাব্য। চৈতন্য দেবের দেবোপম চৈতন্য জীবন সমকালীন এবং উত্তর কালীন কবি শিল্পীকে জীবনী সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করল। মুরারি গুপ্ত, সস্বরূ দামোদর চৈতন্যদেবকে নিয়ে জীবনী গ্রন্থ রচনা করলেন। “চৈতন্য লীলার ব্যাস” বলে পরিচিত বৃন্দাবন দাস তিন খন্ডে লিখলেন “চৈতন্যভাগবত”‌ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচনা করলেন, “শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত” যা বাংলা সাহিত্যে এক এবং অমোঘ জীবনীসাহিত্য। শুধু তাই নয়, এইসব জীবনী কাব্যগুলি সমকালীন ঐতিহাসিক ও সামাজিক দিক থেকেও এর গুরুত্ব যথেষ্ট

চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে এলো পরিবর্তন। বাংলা সাহিত্য মুখ্যত দুটি পর্বে বিভক্ত হয়ে পড়ল যথা – ১)চৈতন্য পূর্বযুগ এবং ২) চৈতন্য উত্তর যুগ। চৈতন্য পূর্ব যুগের কবি বলে পরিচিত বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস এবং চৈতন্য উত্তর যুগের কবি বলে পরিচিত গোবিন্দ, জ্ঞানদাস।

চৈতন্য আবির্ভাবে বৈষ্ণব সাহিত্য নতুনভাবে সজ্জিত হলো। এই সময়ে নানা কবি চৈতন্যদেবের  নব আদর্শে বৈষ্ণব পদ রচনা শুরু করলেন-

১) প্রাকচৈতন্য যুগে বৈষ্ণব পদকর্তাদের আদর্শ ছিল ঐশ্বর্য ভক্তি, কিন্তু চৈতন্য আবির্ভাবে তা পরিণত হলো মধুর ভক্তিতে। শুধু তাই নয়, রাগানুগা ভক্তির দ্বারা প্রভাবিত হলো বৈষ্ণব সাহিত্য।

২) প্রাকচৈতন্য যুগে বৈষ্ণব কবিতীর আদর্শ ছিল ভগবত, বিষ্ণুপুরাণ, সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র কিন্তু চৈতন্য আবির্ভাবে চৈতন্য হলেন চৈতন্য যুগে ও তার পরবর্তী যুগের বিশেষ আদর্শ।

৩) চৈতন্যদেবের প্রভাবে চৈতন্য পরবর্তী যুগে সখ্য ও বাৎসল্য রসের পদের সৃষ্টি হয়। বলরাম দাস এই পর্বে শ্রেষ্ঠ কবি।

চৈতন্যদেব ছিলেন রাধা কৃষ্ণের যুগল অবতার। অর্থাৎ বাইরে রাধা এবং ভিতরে কৃষ্ণ। তাই চৈতন্য পরবর্তী কালে পদাবলীর সাহিত্যে গৌরচন্দ্রিকা এবং গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদের সৃষ্টি হল। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব শ্রীচৈতন্যদেব। গোবিন্দ দাস এই পর্যায়ে অনেক উৎকৃষ্ট পদ লিখেছেন। কীর্তনিয়াগণ রাধা কৃষ্ণের লীলা বর্ণনার আগে বৃন্দাবন লীলার সদৃশ গৌরলীলার পদ গান করার জন্য গৌরচন্দ্রিকা পর্যায়ে গাইতেন। যেমন রাধামোহন এর “আজু  হাম কি পেখলু নবদ্বীপচন্দ্র” প্রভৃতি উৎকৃষ্টপদ বৈষ্ণব সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

মধ্যযুগের অন্যান্য সাহিত্য শাখাতেও চৈতন্যদেবের প্রভাব স্পষ্ট। মঙ্গলকাব্যের মনসা এবং চণ্ডী ছিল এতদিন উগ্র পূজা লোলুপ এবং নির্দয় দেবী কিন্তু চৈতন্যদেবের প্রচারিত ভক্তি ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এইসব দেবী তাদের হিংস্র রূপ পরিহার করে অনেকাংশে মমতাময়ী হয়ে উঠেছেন। দ্বিজ বংশীদাস,  মুকুন্দরাম, দ্বিজ্ মাধবের রচনায় এই দিকটি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দ্বিজ মাধব চন্ডীর মঙ্গল গান করতে গিয়ে বিষ্ণুপদ লিখেছেন। এমনকি ষোড়শ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মঙ্গলকাব্য চন্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চৈতন্য প্রভাব স্বীকার করেই বন্দনা অংশে চৈতন্য বন্দনা করেছেন।

রামায়ণ ও মহাভারত বাঙালির কাছে অতি পরিচিত। কৃত্তিবাস চৈতন্যের আগে রামায়ণ রচনা করলেও পরবর্তীকালে তাতে প্রক্ষেপ ঘটেছে। এই প্রক্ষেপের কারণ চৈতন্যের প্রভাব। তাই বীর রামচন্দ্র কোমল প্রকৃতির, কৌশল্যার মধ্যে মা, যশোদা অথবা শচীদেবীর স্নেহ বাৎসল্য মাতৃত্বের প্রকাশ লক্ষ্য করা গেল। কাশীরাম দাসের রচনাতেও কৃষ্ণ ও অর্জুনের চরিত্রে যে ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়, তার মুলে ছিল চৈতন্য প্রভাব। এছাড়া চৈতন্যের ভক্তি ধর্মের প্রভাবে নানা ভক্তি শাস্ত্রের অনুবাদ হতে থাকলো

সঙ্গত কারণেই অধ্যাপক সুকুমার সেন বলেছেন- “চৈতন্য তাহার জীবনকালেই ঈশ্বর অবতার বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছিলেন এবং তখনই তাহার চরিত্র সংস্কৃত শ্লোকে কাব্যে ও নাটকে এবং বাঙ্গালায় গানে ও কাব্যে কৃতিত্ব হইতে শুরু হইয়াছিল”

(এই প্রশ্নটি ৫ নম্বর এর ক্ষেত্রেও হতে পারে। শুধুমাত্র একটি বিভাগ অর্থাৎ সমাজে চৈতন্যের প্রভাব অথবা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব আলোচনা কর- এইরকম প্রশ্ন ৫ নম্বরে হতে পারে) বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023

বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023

বিদ্যাপতি   ( বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023)

বিদ্যাপতির দুটি গ্রন্থের নাম লেখ। সেই গ্রন্থ দুটি কোন রাজার উদ্দেশ্যে লেখা? পদাবলী সাহিত্যে বিদ্যাপতির অবদান আলোচনা কর।

অথবা- বিদ্যাপতি কোন রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন? তিনি কোন সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন? পদাবলীর সাহিত্যে তার গুরুত্ব আলোচনা কর। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 

উঃ প্রাক চৈতন্য যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদকর্তা হলেন মিথিলার কবি বিদ্যাপতি। রাধা কৃষ্ণের বিষয়কে কেন্দ্র করে পদ রচনা করে সমগ্র পূর্ব ভারতে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি সংস্কৃত, মৈথিলী এবং ব্রজবুলি ভাষায় অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার মধুবনী পরগনার বিসফি গ্রামে, এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বস্তুতঃ ব্রজবুলি ভাষায় লেখা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনার জন্যই বিদ্যাপতি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

বঙ্গদেশে বিদ্যাপতি পদকর্তা হিসেবে হিসাবে পরিচিত কিন্তু পদ রচনা ছাড়াও তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছেন যেমন-

১) “কীর্তিলতা” রাজা কীর্তি সিংহের উদ্দেশ্য লেখা

২) “ভূ-পরিক্রমা” রাজা দেবসিংহকে উদ্দেশ্য করে লেখা।

৩) “কীর্তিপতাকা”, “পুরুষপরীক্ষা”- রাজা শিবসিংহকে উদ্দেশ্যে করে লেখা।

এছাড়াও  “গঙ্গাবাক্যাবলি”, “দানবাক্যাবলী”, “বিভাগসার”, “লিখনাবলী” “দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী” প্রকৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন।

পদাবলীর ছন্দলালিত্য ভাষা সৌন্দর্য, গীতি মাধুর্য এবং ভাব ব্যঞ্জনার জন্য তিনি মিথিলা বাসীর কাছে “মৈথিলী কোকিল” নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথমত, নাগরিক কবি। দ্বিতীয়ত, শিল্পী কবি। চৈতন্য যুগের কবিদের মতো কিংবা চন্ডীদাসের মতো ভক্ত কবি ছিলেন না। তাই শিল্পী কবি ও নাগরিক কবির দৃষ্টিকোণ থেকে রাধা কৃষ্ণের চরিত্র চিত্রনে ব্রতী হয়েছিলেন। তার পদে রাধা ভক্ত চুরামণি বা জীবাত্মার পথিক নন। তার রাধা এক লৌকিক নায়িকা। লৌকিক নায়িকার হৃদয় ব্যাকুলতা কামনা বাসনা ফুটে উঠেছে তার পদগুলিতে। রাধাকে তার বয়সন্ধিকাল থেকে মাথুর বিরহে উত্তীর্ণ করা হয়েছে।রাজসভার কবি বলেই বিদ্যাপতির রুচি ছিল নাগরিক রুচির অনুকূল। তাই বর্ণনা, সম্ভোগ দৃশ্যের বর্ণনা বিরহ ব্যাকুলতার মধ্যে দেহ চেতনার তার পদে প্রাধান্য পেয়েছে।

রাধার বয়সন্ধি পদ রচনা বিদ্যাপতি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। নায়িকার কৈশোর ও যৌবনের যে সন্ধিক্ষণ তাকে বয়সন্ধি বলে। বিদ্যাপতির পদে নায়িকা রাধার প্রেম চেতনায় বিচিত্র ভঙ্গিতে লীলায়িত হয়ে উঠেছে। চৈতন্য উত্তর যুগের পদকর্তারাও বয়সন্ধির পদ রচনা করেছেন। সম্ভবত তাদের রচনায় তথ্যকথা প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু বিদ্যাপতি মানবরসের কবি, তাই তার রচনায় মানবিক চেতনা গভীর মনস্তত্ত্ব ও প্রেমের রহস্য প্রকাশ পেয়েছে।

আরও পড়

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

 

বিদ্যাপতির রচনায় কৃষ্ণ ও দূতির উক্তি প্রত্যুক্তির মধ্যে নায়িকা রাধার বিশুদ্ধ দেহগত বর্ণনা ও মনবিকাশের পর্যায়গুলি বয়ঃসন্ধির স্বরূপটিকে উদঘাটিত করেছে। পূর্বরাগের পরই মিলনস্পৃহা সঞ্চারিত হওয়ায়, নায়ক কৃষ্ণের মনে রাধার দেহ ও মন সম্পর্কে যে কৌতুহল ও জিজ্ঞাসা সেটাই বয়সন্ধিক পদকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে। বয়ঃসন্ধির পদে বিদ্যাপতির কবিতা বর্ণাঢ্য মহিমা অর্জন করেছে। বিদ্যাপতি অধিকতর কাব্য কৌশল অবলম্বনে রাধার বয়ঃসন্ধির দ্বন্দ্বের রূপ অঙ্কন করেছেন। বিদ্যাপতির কাব্যে দূতি এসে কৃষ্ণকে জানিয়েছেন-

 “শৈশব যৌবন দুহু মিলি গেল

 শ্রবণক পথ দুহু লোচন গেল”

 দেহ বর্ণনার মধ্যে দিয়েই মনো চাঞ্চল্যের প্রকাশ ঘটেছে। নারী জীবনের বয়ঃসন্ধির অনুভূতি কবি মনস্তত্ত্ব সম্মতভাবে প্রকাশ করেছেন। তাই বলা যায়, বয়ঃসন্ধির পদ রচনায় বিদ্যাপতি অদ্বিতীয় কলা কুশলী শিল্পী।

বিরহের পদ রচনা বিদ্যাপতি রাজার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। বিরহের অন্তর্গত মাথুর পর্যায়ে পদে বিরহের অন্তর দাহনের সঙ্গে প্রকৃতি তরঙ্গের অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটেছে। যেমন এই  পদে-

 ঝুম্পি ঘন গর্জনতি মন্ডতি

ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।

কান্ত পাহুন কাম দারুন

 সঘনে আর শর হন্তিয়া।

বিরহ যন্ত্রণাদগ্ধ রাধার হৃদয়ার্তিকে কবি বর্ষা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করে রস ঘন করে তুলেছেন। বিরহের এমন শিল্পীত প্রকাশ মধ্যযুগের সাহিত্যে সত্যিই দুর্লভ। বিরহের পদে “বিদ্যাপতির কবিতা রুদ্রাক্ষ মালা” রাধা এখানে বিরহের অগ্নিস্নানে আত্মশুদ্ধ।

বিদ্যাপতি সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের প্রতি প্রবল নিষ্ঠা ছিলেন। ওই অলংকার শাস্ত্রে বর্ণিত নায়ক নায়িকাপ্রকরণ অনুসারে তিনি রাধা কৃষ্ণের পূর্বরাগ, প্রথম মিলন, বাসকসজ্জা, অভিসার, বিপ্রলব্ধা, খন্ডিতা, কলহন্তরিতা, মান, বিরহ, পুনর্মিলন প্রভৃতি বিভিন্ন লীলাপর্যায়ের মধ্যে দিয়ে রাধা কৃষ্ণের বিরহ ও মিলন লীলা বর্ণনা করেছেন। পদগুলি বিভিন্ন সময়ে রচিত হলেও এদের মধ্যে একটা ঘটনা প্রবাহ চোখে পড়ে। এই বিষয়ে কৃষ্ণ বিষয়ক  জয়দেবের গীতগোবিন্দের দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাই তাকে “অভিনব জয়দেব” নামে ভূষিত করা হয়েছে।

জয়দেবের রাধার সঙ্গে বিদ্যাপতির রাধার চরিত্রগত সাদৃশ্য দেখা যায়। বিদ্যাপতির পদাবলীর প্রথমদিকে নায়িকা রাধার যে অনবদ্য মূর্তি অঙ্কিত হয়েছে, তাতে প্রেমঘন চাঞ্চল্য দেহজ কামনার লাবণ্য-উৎসার, সুখ দুঃখ, বিরহ মিলনের, উচ্ছলতা- এমন চমৎকার ফুটে উঠেছে যে, কবির সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব জ্ঞান এবং শিল্পবোধের উচ্চ প্রশংসা করতে হয়। বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদে ভক্তি ও আধ্যাত্মদ রসের ব্যঞ্জনার চেয়ে বাস্তবধর্মী শৃঙ্গার রসের অধিক বাহুল্য, কারণ তিনি ছিলেন রাজসভার বিধব্ধ কবি সুতরাং তার পদে নাগরিক বৈদগ্ধ থাকবেই।

বিদ্যাপতির ভাষা, ছন্দ, অলংকার, গীতিধর্মিতায় তার পদ পূর্ব ভারতের শীর্ষ স্থানীয়। বাংলার বহু বৈষ্ণব পদকার তার পথ ধরেই চলেছেন। তার শ্রেষ্ঠ ভাবশিষ্য হচ্ছেন গোবিন্দদাস কবিরাজ। যিনি বিদ্যাপতির রূপ রীতি ও আবেগের দ্বারা কৃতিত্বের সঙ্গে অনুসরণ করেছিলেন বৈষ্ণব পদের জন্যই। “মৈথিল কোকিল” ও “অভিনব জয়দেব” বিদ্যাপতি ঠাকুর ভিনপ্রদেশী  হয়েও বৈষ্ণব পদের জন্যই বাঙালির পরম আত্মীয় বলে গৃহীত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023

 

you may like it

https://en.wikipedia.org/wiki/India

 

বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023 বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023

Ratan Das

Learn More

One thought on “বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য প্রভাব বিদ্যাপতি 2023

Comments are closed.