মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিবাদর ও গুণী সাহিত্যিক হলেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী | এই সিরিজে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। পাঠক পাঠিকাদের মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর সম্পর্কে সমস্ত অজানা তথ্য এই সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ সেই দিকে নজর রেখে পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী-শুধু মঙ্গলকাব্য ধারায় নয়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন, মুকুন্দ চক্রবর্তী। তার “অভয়ামঙ্গল” কাব্যের জন্য বাংলা সাহিত্যে, তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। কবির আসল নাম অনেকে বলেছেন মুকুন্দরাম কিন্তু সুকুমার সেন জানিয়েছেন কবির প্রকৃত নাম মুকুন্দ।
কবিপরিচয়:-
কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর পূর্বপুরুষ মাধব ওঝার নিবাস ছিল কর্ণপুরে। পরে বর্ধমানের দামিন্যা বা দামুন্যা গ্রামে বসবাস করেন। তার পিতার নাম হৃদয় মিশ্র। মাতার নাম দৈবকী। তার পিতামহের নাম জগন্নাথ মিশ্র। তাঁর পুত্রের নাম শিবরাম এবং মহেশ। কন্যা যশোদা। তিনি ষোড়শ শতকের চন্ডীমঙ্গলের সর্বশ্রেষ্ঠ। ডিহিদার মামুদ শরীফের অত্যাচারে তিনি বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করে মেদিনীপুর জেলার আরড়া গ্রামে আসেন।কবি মেদিনীপুরের আরড়া গ্রামে বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় লাভ করেছিলেন এবং তার পুত্র রঘুনাথ রায়ের গৃহে শিক্ষক নিযুক্ত হন। তার আশ্রয়দাতা রঘুনাথ রায় তাকে “কবিকঙ্কন” উপাধি প্রদান করেছিলেন।
কাব্য নাম
তার কাব্য ভনিতায় কাব্যের নাম বিভিন্ন পাওয়া গেছে। তার কাব্যের নামগুলি হল- ১) অভয়ামঙ্গল ২) অম্বিকামঙ্গল ৩) চন্ডিকামঙ্গল ৪) চন্ডীমঙ্গল ৫) গৌরী মঙ্গল প্রভৃতি ভনিতায় তার কাব্যের নাম পাওয়া গেছে।সাহিত্য বিষয়ে আরো জানতে- click here
কাব্য পরিচয় –
অভয়ামঙ্গল কাব্যে চারটি খণ্ড আছে। যথা:-
- বন্দনা খন্ড
- দেবখন্ড
- আখেটিক খন্ড
- বণিক খণ্ড
চন্ডীমঙ্গল কাব্য ধারার শ্রেষ্ঠ কবি কে?
মুকুন্দরামের “অভয়মঙ্গল” কাব্যটি রামজয় বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় ১৮২৩-২৪ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয়। প্রখ্যাত সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার “বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা” গ্রন্থে “অভয়মঙ্গল” কাব্য সম্পর্কে বলেছেন- “এযুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন উপন্যাসিক হইতেন তাহাদের সংশয় মাত্র নয়” অর্থাৎ চন্ডীমঙ্গলের কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র-চিত্রন, বাস্তব জীবন রস, ঘটনা পরম্পরা এবং চরিত্র গুলির বাস্তব দ্বন্দ্ব- যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাতে তার কাব্যে যে উপন্যাসিক গুন বর্তমান ছিল তা আমরা বলতে পারি। কবি মুকুন্দ তার কাব্যকে “নতুন মঙ্গল” বলে ঘোষণা করেছেন।
চরিত্র- আখেটিক খন্ডে-কালকেতু, ফুল্লরা, ভাড়ু দত্ত, মুরারি শীল। বণিক খন্ডে- ধনপতি, লহনা, খুল্লনা, শ্রীমন্ত, দুর্বলা। কালজ্ঞাপক শ্লোক- শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গনিতা / কত দিনে দিলা গীত হরের বনিতা।
১) মুকুন্দ চক্রবর্তীর “অভয়ামঙ্গল” কাব্যে কোন কোন উপন্যাসিক লক্ষণ দেখা যায়/অথবা- মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যকে কি উপন্যাসিক গুন সম্পন্ন কাব্য বলা যায়? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও।
উঃ) উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল- কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র- চিত্রন, বাস্তব জীবন রস পরিবেশন এবং কাহিনী ও ঘটনার মধ্যে জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপন এবং সেই সঙ্গে জীবনের প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যই মধ্যযুগের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যে ফুটে উঠেছে। যদিও উপন্যাস আধুনিক যুগের সৃষ্টি, তবুও মুকুন্দ চক্রবর্তীর অভয়ামঙ্গল কাব্যে উপন্যাসের ধারাবাহিক বস্তুনিষ্ঠ গল্প, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা,
সর্বোপরি আখ্যায়িকা এবং চরিত্রের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপনে, যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে তার কাব্যে, উপন্যাসিক গুন যে বর্তমান ছিল, তা আমরা বলতে পারি। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, হাসি-কান্না প্রভৃতি কবি যেভাবে চিত্রিত করেছেন, তা একজন যথার্থ উপন্যাসিকের কলমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে অর্থাৎ কালকেতুর জন্ম, বিবাহ, দেবীর ধন-প্রধান, ভাড়ু দত্তের চালাকি, ফুল্লরার দুঃখ-কষ্ট, কালকেতুর নগর স্থাপন ইত্যাদি, সমস্ত ঘটনা যেন উপন্যাসিকের কলমে প্রস্ফুটিত হয়েছে তাই তার কাব্যকে উপন্যাসিক লক্ষণাক্রান্ত কাব্য বলা যায়।
২) বাংলা সাহিত্যে মুকুন্দ চক্রবর্তীর অভয়মঙ্গল কাব্যটির গুরুত্ব কি? /অথবা- চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবির নাম কি? তার কাব্যের নাম কি? কাব্যটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উঃ) শুধুমাত্র চন্ডীমঙ্গল কাব্য ধারায় নয়, সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন মুকুন্দ চক্রবর্তী। তার অভয়ামঙ্গল কাব্যটির জন্যই তিনি বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। কাব্যটি চারটি খন্ড আছে। যথা- বন্দনা খন্ড, দেব খন্ড, আখেটিক খন্ড, বণিক খন্ড
কাব্যটি চরিত্র-চিত্রনে, ঘটনা পরম্পরায়, বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতায় এবং মনস্তাত্ত্বিক দন্দ্বে, কাব্যটিতে আধুনিক যুগের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। কাব্যটির কালকেতুর জন্ম, বিবাহ, ভাড়ু দত্তের চালাকি, ফুল্লরা দুঃখ কষ্ট, তথা মানবিক চরিত্রের হাসি- কান্না, মান-অভিমান, দুঃখ ইত্যাদি জীবন রস কাব্যটিতে মুকুন্দ চক্রবর্তী অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই কাব্যটি উপন্যাসিক লক্ষণ আক্রান্ত কাব্য বলা যায়।
চন্ডীমঙ্গল কাব্য ধরার অন্যান্য কবিগণ:– মানিক দত্ত:– চন্ডীমঙ্গল কাব্য ধারার আদি কবি, আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীর কবি। দ্বিজ মাধব বা মাধব আচার্য:– ইনি ষোড়শ শতাব্দীর কবি।
দ্বিজ রামদেব:– সপ্তদশ শতাব্দীর কবি। এছাড়াও আছেন রামানন্দ যতি, অকিঞ্চন চক্রবর্তী, মুক্তারাম সেন প্রভৃতি অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি।
for more question answers click here